বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫ খ্রিঃ-১৯১১খ্রিঃ)

ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে জুলাই তিনি এক আদেশ বলে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন । এই বিভক্তি ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নবাব সলিমুল- নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়।

বঙ্গভঙ্গ পটভূমি :

  • ভাগ হবার পূর্বে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যে প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ দিয়ে গঠিত ছিল বাংলা প্রদেশ বা বাংলা প্রেসিডেন্সি।
  • ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল গোয়ালপাড়া, কাছাড় এবং শ্রীহট্টকে নিয়ে আসাম নামে একটি পৃথক প্রদেশ গঠিত হয় ।
  • ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে আসামের চীফ কমিশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন । প্রবল বিরোধিতার জন্য তাঁর সে প্রস্তাব বাতিল হয় ।
  • তাঁর উত্তরসুরি হেনরি কটনও এটিকে অবাস্তব ও অসংগত বলে মন্তব্য করেন । ফলে প্রস্তাবটি তখনকার মতো বাতিল হয় ।
  • ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র সচিব এইচ. এইচ. রিজলী উইলিয়াম ওয়ার্ডের প্রস্তাবকে আরও সম্প্রসারিত করে বঙ্গভঙ্গের এক নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন । এতে বলা হয় চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে । উড়িয়া ভাষি অঞ্চলকে বাংলার অবশিষ্টাংশের সঙ্গে যুক্ত করা হবে এবং ছোটনাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হবে ।
  • লর্ড কার্জন রিজলীর এই প্রস্তাবকে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে গ্রহণ করেন । পরিবর্তিত এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ, মালদহ, পার্বত্য ত্রিপুরা ও আসামকে একত্রিত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে যার রাজধানী হবে ঢাকা । বাংলার অবশিষ্টাংশ, বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠিত হবে 'বঙ্গদেশ' যার রাজধানী হবে কলকাতা ।
  • ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে বলে সরকার ঘােষণা করে ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন:

  • ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও বাংলার জাতীয়তাবাদীগণ এই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন।
  • এই আন্দোলনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বালগঙ্গাধর তিলকসহ গোখলের মতো উদারপন্থী নেতাও অংশ নেন।
  • সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বঙ্গভঙ্গকে জাতীয় দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেন।
  • কার্জন তাঁর সিমলা ঘোষণায় "বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত " বলে উল্লেখ করলে তার উত্তরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দৃঢ়ভাব জানিয়েছিলেন "আমি এই অনড় সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটাবই" ।
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাব অনুসারে ওই দিন সাম্প্রদায়িক সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক স্বরূপ 'রাখিবন্ধন উত্সব [Rakhi Bandhan Utsav]' পালন করা হয় ।
  • রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর পরামর্শে বাঙালির ঐক্যের নিদর্শন স্বরূপ ঘরে ঘরে 'অরন্ধন' [Arandhan] পালিত হয় । হাটবাজার, দোকানপাট, স্কুল কলেজ, আদালত বন্ধ থাকে ।
  • বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে ছাত্রদলকে সরিয়ে আনার জন্য কার্লাইল সার্কুলার ১০ অক্টোবর ১৯০৫, লিয়ন সার্কুলার ১৬ অক্টোবর ১৯০৫, পেডলার সার্কুলার ২১ অক্টোবর ১৯০৫ জারি করা হয়। এইসব সার্কুলারের বিরুদ্ধে ছাত্রনেতা শচীন্দ্রনাথ বসু কলকাতায় অ্যান্টি সার্কুলার সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন

  • বয়কট আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিলেতি পণ্য বর্জন। ক্রমে ক্রমে বয়কট শব্দটি ব্যাপক অর্থ ব্যবহার হতে থাকে। বয়কট শুধু বিলেতি পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিলেতি শিক্ষা বর্জনও কর্মসূচিতে যুক্ত হয়।
  • কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ই জুলাই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সামগ্রিক বয়কট আন্দোলনের আহ্বান জানানো হয় । তিনি দেশবাসীকে বিদেশি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান । তাঁর এই বয়কট ও স্বদেশি আদর্শ দেশবাসীর অন্তরে বিপুল সাড়া জাগায় ।
  • কংগ্রেস নেতারা গ্রামে-গঞ্জে-শহরে প্রকাশ্য সভায় বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে ফেলা এবং দেশীয় পণ্য ব্যবহারের জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে থাকেন। ফলে বিলেতি পণ্যের চাহিদা কমে যেতে থাকে। একই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে এ সময় দেশি তাঁতবস্ত্র, সাবান, লবণ, চিনি ও চামড়ার দ্রব্য তৈরির কারখানা গড়ে উঠে। ঐ সময় আধুনিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ বেঙ্গল কেমিক্যাল ’ , ডা. নীলরতন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয় সাবান কারখানা , জামসেদজি টাটা প্রতিষ্ঠা করেন টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি ।
  • আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন বাড়াবার জন্য বাংলার জেলায় জেলায় বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেমন ঢাকায় অনুশীলন, কলকাতায় যুগান্তর সমিতি, বরিশালে স্বদেশী বান্ধব, ফরিদপুর ব্রতী, ময়মনসিংহে সাধনা ইত্যাদি সংগঠনের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো।
  • স্বদেশি আন্দোলনে প্রেরণা জোগাতে রচিত হয় বহু স্বদেশি – আদর্শ ভিত্তিক কবিতা , গান ও নাটক । এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ বাংলার মাটি বাংলার জল , বাংলার বায়ু , বাংলার ফল , পুণ্য হউক , পুণ্য হউক , পুণ্য হউক , হে ভগবান ”, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, রজনীকান্ত সেনের “ মায়ের দেওয়া মােটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই ” , মুকুন্দ দাসের “ ফেলে দে রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী কভু হাতে আর পরাে না ” ইত্যাদি । দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচনা করেন মেবার পতন ’ , ‘ দুর্গাদাস ’ , ‘ প্রতাপ সিংহ ’ প্রভৃতি দেশাত্মবােধক নাটক ।
  • বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাগুলোও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে ‘ বেঙ্গলী ’ , ‘ কেশরী ’ , ‘ দ্য হিন্দু ’ , ‘ মারাঠা ’ , ‘ অমৃতবাজার ‘ , ‘ সঞ্জীবনী ’ , ‘ সন্ধ্যা ’ প্রভৃতি কঠোর ভাষায় ইংরেজের এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানায় ।
  • ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের দমন করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত করে। রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত সফরে এসে ১৯১১ সালে দিল্লি দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদেরর ঘোষণা দেন।
  • এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মুসলিম নেতা হলেন- মৌলানা আজাদ, লিয়াকৎ হোসেন, আব্দুল রসুল, আব্দুল হাকিম গুজনাভি।